অন্ধকারে দেড়শো বছর : চর্যাপদ রচিত হয়েছিলো ৯৫০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে। কিন্তু এরপরেই বাঙলা সাহিত্যের পৃথিবীতে নেমে আসে এক করুণ অন্ধকার, আর সে-আঁধার প্রায় দেড়শো বছর টিকেছিলো। ১২০০ অব্দ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লেখা কোনো সাহিত্য আমাদের নেই। কেনো নেই? এ-সময়ে কি কিছুই লেখা হয় নি? কবিরা কোথায় গিয়েছিলেন এ সময়? কোনো একটি ভাষায় দেড়শো বছরের মধ্যে কেউ কিছু লিখলো না, একি সম্ভব হতে পারে?
কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না যে এ-সময়ে কিছু লেখা হয় নি। ১২০০ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত কোনো সাহিত্যকর্মের পরিচয় পাওয়া যায় না ব’লৈ এ-সময়টাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এ সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি। এ সময়টির দিকে তাকালে তাই চোখে কোনো আলো আসে না, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।
১২০০ থেকে ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত ক’রে বাঙলায় আসে মুসলমানেরা। অনেকে মনে করেন মুসলমানেরা এতো অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়েছিলো যে কারো মনে সাহিত্যের কথা জাগে নি। তাই এ সময়ে বাঙলা ভাষা সাহিত্যহীন মরুভূমি। কিন্তু এ-যুক্তি মানা যায় না। কেননা দেড়শো বছর ধ’রে রক্তপাত চলতে পারে না। তাহলে মানুষ রইলো কী ক’রে? মুসলমানেরা তো বাঙালিদের মারার জন্যেই আসে নি, তারা এসেছিলো রাজত্ব করতে।
[ অন্ধকারে দেড়শো বছর | লাল নীল দীপাবলি | হুমায়ুন আজাদ | বাংলা প্রস্ততি ]
এছাড়া পরবর্তীকালে দেখা গেছে মুসলমান রাজারা বাঙলা সাহিত্যকে বেশ উৎসাহ দিচ্ছে। যারা পরে সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ দিলো, তারাই আগে সাহিত্যকে দমিয়ে দিয়েছিলো এরকম হ’তে পারে না। বাঙলা সাহিত্যকে ধ্বংস করার জন্যে তো আর তারা আসে নি। তাহলে সাহিত্য হলো না কেনো, কেনো আমরা পাই না একটিও কবিতা, একটিও কাহিনীকাব্য? আগে সাহিত্য লিখিত হতো না, মুখে মুখে গাওয়া হতো।
তখন ছাপাখানা ছিলো না, পুথি লিখিয়ে নেয়ায় ছিলো অনেক অসুবিধা। তাই কবিরা মুখে মুখে রচনা করতেন তাঁদের কবিতা, কখনো তা হয়তো হতো ছোটো আয়তনের, কখনো বা হতো বিরাট আকারের। রচনা করে তা স্মরণে রেখে দিতেন, নানা জায়গায় গাইতেন। কবিতা যারা ভালোবাসতো তারাও মুখস্থ করে রাখতো কবিতা। এভাবে কবিতা বেঁচে থাকতো মানুষের স্মৃতিতে, কণ্ঠে। আজকের মতো ছাপাখানার সাহায্য সেকালের কবিরা লাভ করেন নি। তাই যে-কবিতা একদিন মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যেতো, সে-কবিতা হারিয়ে যেতো চিরকালের জন্যে।
তাহলে চর্যাপদকে লেখা অবস্থায় পাওয়া গেলো কেমনে? এ-বইটি কিন্তু বাঙলায় পাওয়া যায় নি, পাওয়া গেছে নেপালে। নেপালের ভাষা বাঙলা নয়। বাঙলা ভাষাকে ধ’রে রাখার জন্যে প্রয়োজন হয়েছিলো একে বর্ণমালায় লিখে রাখার। তাই অন্ধকার সময়ের রচনার সম্বন্ধে আমরা অনুমান করতে পারি যে এ-সময়ে যা রচিত হয়েছিলো, তা কেউ লিখে রাখে নি, তাই এতোদিনে তা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে।
তবু বিস্ময় থেকে যায়, কারণ দেড়শো বছর ধ’রে কোনোও কবিতা লিপিবদ্ধ হলো না, এ কেমন? এর পরে তো আমরা বাঙলা সাহিত্যের ধারাবাহিক ইতিহাস পাচ্ছি, আমাদের সামনে আসছে একটির পরে একটি মঙ্গলকাব্য, আসছে পদাবলির ধারা। ১৩৫০ সালের পরেই আসেন মহৎ মহৎ কবিরা; আসেন বড়ু চণ্ডীদাস তাঁর শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য নিয়ে, এবং আসর মাতিয়ে তুলেছেন আরো কতো কবি। অন্ধকার যুগ আমাদের কাছে এক বিস্ময়। এ-সময়টা বাঙলা সাহিত্যের কৃষ্ণগহ্বর।
এ-বিস্ময় আর অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে কেউ কেউ অন্য রকম কথা বলেছেন। তাঁরা বলেন, চর্যাপদকে যদি আমরা বাঙলা না বলি, তাহলে অন্ধকার যুগ ব’লে কিছু থাকে না, বাঙলা সাহিত্য শুরু হয় চতুর্দশ শতক থেকে। কিন্তু চর্যাপদ যে বাঙলা, তা কী ক’রে ভুলে যাই। চর্যাপদ-এ বাঙলা ভাষার জন্মের পরিচয় পাই, মধ্যযুগের রচনায় পাই বাঙলা ভাষার বিকাশের পরিচয়। মাঝখানে থেকে যায় একটি অন্ধকারের পর্দা, জমাট অন্ধকার, যার আবির্ভাবের কোনো ঠিক কারণ কেউ দেখাতে পারবেন না।
আরও পড়ুন:
লাল নীল দীপাবলি | হুমায়ুন আজাদ | বাংলা প্রস্ততি
হুমায়ূন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ (এপ্রিল ২৮, ১৯৪৭–আগস্ট ১১, ২০০৪) (বৈশাখ ১৪, ১৩৫৪–শ্রাবণ ২২, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বাঙলাদেশি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনীতিক ভাষ্যকার। তিনি বাঙলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ, রাজনৈতিক এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ১৯৮০’র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গতানুগতিক চিন্তাধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করতেন। তাঁর নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) এবং পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড়তোলে এবং পরবর্তীতে বাঙলাদেশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একজন প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক মননশীল লেখক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৭০ টির বেশি। আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ নারী প্রকাশ করে গোটা দেশে সাড়া তুলেন। বইটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাঙলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলো। এ-গ্রন্থ তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবেও স্বীকৃত। তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাঙলা একাডেমী পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তাঁর রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আব্বুকে মনে পড়ে জাপানি ভাষায় অনুদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।
জীবনের শেষার্দ্ধে অকুতোভয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, নারীবাদী বক্তব্য এবং একই সঙ্গে নিঃসংকোচ যৌনবাদিতার জন্যে তিনি ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভীষ্ট তাঁর সাহিত্যকে প্রবলভাব প্রভাবান্বিত করেছিল। লেখার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণের কারণে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন।