অভিশাপ কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম

অভিশাপ কবিতা – অভিশাপ কবিতার ভাববস্তু কবিচিত্তের এক অভিমান। কবি তাঁর প্রেমিকার কাছে যথাযোগ্য প্রীতির বিনিময় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাই তাঁর হৃদয় এক গভীরতর বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এই কবিতা ভাববস্তুর মধ্যে কবির বেদনাহত চিত্তের প্রকাশই দেখা দেয়।

 

বিদ্রোহী কবিতা - কাজী নজরুল ইসলাম

 

 

 

কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বৎসরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি।

তার জীবন শুরু হয়েছিল অকিঞ্চিতকর পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজন্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

যে নজরুল সুগঠিত দেহ, অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসির জন্য বিখ্যাত ছিলেন, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারাত্মকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্মিকভাবে তার সকল সক্রিয়তার অবসান হয়। ফলে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু অবধি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রযোজনায় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকা স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭৬ সালে তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

অভিশাপ কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম

 

কাজী নজরুল ইসলাম 2 অভিশাপ কবিতা – কাজী নজরুল ইসলাম

 

যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!
ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হ’লে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মর” কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি’
যেদিন আমায় খুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্‌ রাতে জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোঁওয়ায় উঠবে ও-বুকে ছমকে,-
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব’সনু বুকের কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদ্‌নাতে চোখ বুঁজবে-
বুঝবে সেদিন বুজবে।

গাইতে ব’সে কন্ঠ ছিঁড়ে আস্‌বে যখন কান্না,
ব’লবে সবাই-“ সেই য পথিক তার শেখানো গান না?’’
আস্‌বে ভেঙে কান্না!
প’ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প’ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্র”-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে-
বুঝ্‌বে সেদিন বুঝবে!

আবার যেদিন শিউলি ফুটে ভ’রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে ফুল গাঁথতে মালা কাঁপবে তোমার কঙ্কণ-
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প’ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি’!
বুকের মালা ক’রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আসবে আবার আশিন-হাওয়া, শিশির-ছেঁচা রাত্রি,
থাকবে সবাই – থাকবে না এই মরণ-পথের যাত্রী!
আসবে শিশির-রাত্রি!
থাকবে পাশে বন্ধু স্বজন,
থাকবে রাতে বাহুর বাঁধন,
বঁধুর বুকের পরশনে
আমার পরশ আনবে মনে-
বিষিয়ে ও-বুক উঠবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আসবে আবার শীতের রাতি, আসবে না ক আ সে-
তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে,
আসবে না ক’ আর সে!
প’ড়বে মনে, মোর বাহুতে
মাথা থুয়ে যে-দিন শুতে,
মুখ ফিরিয়ে থাকতে ঘৃণায়!
সেই স্মৃতি তো ঐ বিছানায়
কাঁটা হ’য়ে ফুটবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে,
সেই তরীতে হয়ত কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে-
দুলবে তরী রঙ্গে,
প’ড়বে মনে সে কোন্‌ রাতে
এক তরীতে ছিলেম সাথে,
এমনি গাঙ ছিল জোয়ার,
নদীর দু’ধার এমনি আঁধার
তেম্‌নি তরী ছুটবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

তোমার সখার আসবে যেদিন এমনি কারা-বন্ধ,
আমার মতন কেঁদে কেঁদে হয়ত হবে অন্ধ-
সখার কারা-বন্ধ!
বন্ধু তোমার হান্‌বে হেলা
ভাঙবে তোমার সুখের মেলা;
দীর্ঘ বেলা কাটবে না আর,
বইতে প্রাণের শান- এ ভার
মরণ-সনে বুঝ্‌বে-
বুঝবে সেদিন বুঝ্‌বে!

ফুট্‌বে আবার দোলন চাঁপা চৈতী-রাতের চাঁদনী,
আকাশ-ছাওয়া তারায় তারায় বাজবে আমার কাঁদ্‌নী-
চৈতী-রাতের চাঁদ্‌নী।
ঋতুর পরে ফির্‌বে ঋতু,
সেদিন-হে মোর সোহাগ-ভীতু!
চাইবে কেঁদে নীল নভো গা’য়,
আমার মতন চোখ ভ’রে চায়
যে-তারা তা’য় খুঁজবে-
বুঝ্‌বে সেদিন বুঝ্‌বে!

আস্‌বে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটীর সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন-
টুটবে যবে বন্ধন!
পড়বে মনে, নেই সে সাথে
বাঁধবে বুকে দুঃখ-রাতে-
আপনি গালে যাচবে চুমা,
চাইবে আদর, মাগ্‌বে ছোঁওয়া,
আপনি যেচে চুমবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।

আমার বুকের যে কাঁটা-ঘা তোমায় ব্যথা হান্‌ত,
সেই আঘাতই যাচবে আবার হয়ত হ’য়ে শ্রান–
আসবে তখন পান’।
হয়ত তখন আমার কোলে
সোহাগ-লোভে প’ড়বে ঢ’লে,
আপনি সেদিন সেধে কেঁদে
চাপ্‌বে বুকে বাহু বেঁধে,
চরণ চুমে পূজবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

 

অভিশাপ কবিতা
অভিশাপ কবিতা

 

অভিশাপ কবিতার মূলভাব:

কবি মনে করেন যেদিন তিনি হারিয়ে যাবেন সেদিন তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন হবে। কবিপ্রিয়া তাঁকে সম্যক বুঝতে পারেন নি তাই সে তাঁর অবর্তমানে তাঁকে হয়ত খোঁজ করবে অরণ্য-পর্বতে সমুদ্রে-মরুভূমিতে। সেদিন অন্তপারের সন্ধ্যাতারার কাছে তাঁর বার্তা নেবার জন্য হয়তো দয়িতা ডাক দেবে। অথচ গভীর রাতে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তাকে খোঁজ করে চলবে। তখন হয়তো আবিষ্কার করবে শূন্য শয্যা শূন্য স্বপ্ন। কবিপ্রিয়া বেদনায় তখন চোখ বুঝবেন। গানের আসরে তাঁর দয়িতার দু’চোখ জলে ভরে যাবে। কারণ আসরে বসে কবির গান গাইতে সকলে তাঁকে অনুরোধ করবে।

কবিপ্রিয়া সেই গাইতে গাইতে বেদনার রাগিণী সৃষ্টি করবেন। বেহাগের কান্নায় তাঁর দয়িতার দু-চোখ জলে ভরে যাবে। তখন মনে পড়বে জীবনের অনেক ফাঁকির কথা। কবির সঙ্গে মিলনের অনেক সুখস্মৃতি কবিপ্রিয়াকে বিদ্ধ করবে। কবির সমাধিক্ষেত্রে ফুল দিতে গিয়ে হয়তো তার কবির কথা মনে পড়বে। আশ্বিনের হাওয়ায় হাওয়ায় শিশির ভেজা রাত্রি নেমে এলে কবিপ্রিয়ার অন্তরে স্মৃতির দাহন দেখা দেবে। রাত্রে অন্যের বাহুবন্ধনে থেকেও প্রেমিকের স্মৃতি, তার স্পর্শভরা সোহাগ প্রেয়সীকে বেদনার্ত করে তুলবে। শীতের কবো মিলনে কবি থাকলে হয়তো তার সুখানুভব পূর্ণ হত না বর্ধিত হত।

তবু কবির বাহুবন্ধনের স্মৃতি তাকে দগ্ধ করবে। নদীর জোয়ারের বুকে এক তরীতে ভেসে যেতে যেতে কবিপ্রিয়ার মনে পড়বে তার অতীতের সুখস্মৃতির কথা। তখন এই স্মৃতি তাঁকে বিদ্ধ করবে, তাঁর মূল্যকে বুঝতে সাহায্য করবে। কবির অভিশাপ এত ঋজু যে কবি মনে করেন কবির মতোই তাঁর প্রেয়সীর নূতন নায়ককে কারাবাসের দুঃখভোগ করতে হবে। তখন হয়তো কবিপ্রিয়ার দু-চোখ কান্নায় অন্ধ হয়ে যাবে ক্লান্তির ভার বইতে বইতে কবিপ্রিয়া হয়তো তন্দ্রামগ্ন হয়ে যাবে, তখন মৃত্যুসম যন্ত্রণা তাকে হয়ত দগ্ধ করবে।

যেদিন ঝড় আসবে, তুফান গর্জন করবে সেদিন কবি আর কবিপ্রিয়ার কাছে থাকবে না তখন কে তাকে নিরাপত্তার নিশ্চিতি দেবে ? কে তাকে সান্ত্বনা দেবে? এ-কথা কবিপ্রিয়া জানে না। দুঃসময়ের রাতে কবি তাকে বাহুবন্ধনে বেঁধে সোহাগ-চুম্বনে যেভাবে তাকে স্নিগ্ধ করেছিল সেই স্মৃতি তখন তাকে দুঃখ দেবে। কবিপ্রিয়া হয়তো এইভাবে কবির মূল্যায়ন করে তাকে আবার প্রেমের সোহাগে ভরিয়ে তুলতে নতুন করে খুঁজবেন।

 

অভিশাপ কবিতা আবৃত্তি:

 

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment