বাঙালি দার্শনিক সূচি। একজন দার্শনিক হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি দর্শন শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এই ব্যক্তির সাধারণত এক বা একাধিক বিষয়ের উপর বিস্তর জ্ঞান থাকে। সেসকল বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নন্দনতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, যুক্তি, অধিবিদ্যা, সামাজিক দর্শন ও রাজনৈতিক দর্শন।
দর্শন বাঙালির দর্শনচর্চার ইতিহাস হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। প্রথম বাঙালি দার্শনিক হিসেবে যিনি সুপ্রসিদ্ধ, তিনি হলেন খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের বৌদ্ধ আচার্য শান্তদেব। তাঁর তিনটি উল্লেখযোগ্য দার্শনিক গ্রন্থ হলো শ্রীগুহ্যসমাজ-মহাযোগ-তন্ত্রবলিবিধি, সহজগীতি ও চিত্তচৈতন্য-শমনোপায়। অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত বৌদ্ধ বিহারগুলি ছিল দার্শনিক তত্ত্বালোচনা তথা সর্ব প্রকার বিদ্যাচর্চার কেন্দ্রস্থল। সেসময় বৌদ্ধ আচার্যগণ যেসব তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলির অধিকাংশই আজ বিলুপ্ত বা দুষ্প্রাপ্য। তবে তিববত, চীন ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সেসব গ্রন্থের কিছু কিছু অনুবাদ সংরক্ষিত আছে।
বজ্রযানী বৌদ্ধ আচার্যদের মধ্যে নৈয়ায়িক শান্তরক্ষিত অন্যতম। তিনি তিনটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। নালন্দার বিশিষ্ট পন্ডিত শীলভদ্র ও মহাচার্য অতীশ দীপঙ্কর (দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, ৯৮০-১০৫৩) ছিলেন সে যুগেরই বাঙালি মনীষী। তাঁরা সংস্কৃত ভাষায় যেসব গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি এখন দুষ্প্রাপ্য। বর্তমানে প্রাপ্য দশম শতকের চর্যাপদেও দর্শনচর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়।
Table of Contents
বাঙালি দার্শনিক সূচি:
অ
অক্ষয়কুমার দত্ত
অমর্ত্য সেন
আ
আবু সয়ীদ আইয়ুব
গ
গুরুচাঁদ ঠাকুর
গোবিন্দ চন্দ্র দেব
জ
জালালুদ্দিন আবদুর রহিম
ম
মধুসূদন সরস্বতী
য
যদুনাথ সিংহ
র
রামতনু লাহিড়ী
রামমোহন রায়
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
শিবনারায়ণ রায়
ল
লালন
শ
শীলভদ্র
স
প্রভাতরঞ্জন সরকার
সিরাজ সাঁই
সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত
হ
- হুমায়ুন কবীর | বাঙালি শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক ও দার্শনিক
গৌড়পাদের অধ্যাত্মচিন্তা ও দার্শনিক মতবাদ নিয়ে গ্রন্থ রচনা করে সর্বভারতীয় খ্যাতি অর্জন করেন দশম শতকের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ শ্রীধর ভট্ট। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে ন্যায়কন্দলী, অদ্বয়সিদ্ধি, তত্ত্বপ্রবোধ ও তত্ত্বসংবাদিনী বিখ্যাত। চৌদ্দ শতকে শঙ্করের মায়াবাদ খন্ডনের চেষ্টা করেন গৌড় পূর্ণানন্দ। সেই প্রাচীন যুগে এ দেশে স্মৃতি-মীমাংসা, এমনকি ষড়দর্শনের চর্চাও প্রচলিত ছিল। ন্যায়শাস্ত্রে বিচক্ষণতার জন্য গৌড়ীয় নৈয়ায়িকেরা সমগ্র ভারতবর্ষে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পনেরো শতকে নবদ্বীপে ব্যাপকভাবে ন্যায়চর্চা শুরু হয় এবং সে ধারা অব্যাহত থাকে আঠারো শতক পর্যন্ত। পনেরো শতকের হরিদাস ন্যায়ালঙ্কার, ষোলো শতকের রঘুনাথ শিরোমণি, কণাদ তর্কবাগীশ এবং সতেরো শতকের জগদীশ তর্কালঙ্কার, জয়রাম পঞ্চানন, গদাধর ভট্টাচার্য প্রমুখ ছিলেন নব্যন্যায়ের বিখ্যাত বাঙালি পন্ডিত।
বাঙালির দর্শনচিন্তা প্রধানত দুটি ধারায় বিকশিত হয়েছে: ধর্মীয় ধারা ও ধর্মনিরপেক্ষ ধারা। প্রথম ধারার মূল ভিত্তি ধর্ম। এখানে আবার দুটি উপধারা দেখা যায়: একটি কেবলই পরলোকমুখী ও অধ্যাত্মবাদী এবং অন্যটি একই সঙ্গে ঐহিক ও পারলৌকিক তত্ত্বে বিশ্বাসী। দ্বিতীয় উপধারার অনুসারীরা পরলোক-পরমেশ্বরে বিশ্বাস করেও ইহজগৎ ও ইহজীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আকাঙ্ক্ষী, অর্থাৎ দর্শনকে তাঁরা জাগতিক কল্যাণে প্রয়োগেও আগ্রহী। আর দ্বিতীয় ধারা ধর্ম কিংবা পরলোকতত্ত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করে কেবল মানুষের জাগতিক সুখের কথাই বলেছে।
ধর্মনিরপেক্ষ ধারার প্রচলন ছিল প্রাচীনকাল থেকেই। এ ধারার প্রবক্তারা ছিলেন মূলত জীবনবাদী। তাঁরা জীবনকাঠি বলতে বুঝতেন দেহমনে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠাকে, দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব আশা করতেন যোগতান্ত্রিক কায়াসাধনার মাধ্যমে এবং অনুশীলন করতেন সাংখ্য, যোগ, তন্ত্র প্রভৃতি নিরীশ্বরবাদী দর্শনের। বাঙালির দর্শনচিন্তায় ধর্মীয় প্রভাব লক্ষ করা যায় মধ্যযুগ থেকে। এ সময়ের চিন্তায় ও সাহিত্যে ধর্মের প্রভাব ছিল অসামান্য এবং জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সহজ সমাধানের প্রত্যাশায় তারা দেবদেবী ও পীর-দরবেশের শরণাপন্ন হতো। তবে তাদের এ প্রবণতা একান্তই পরলোকমুখী ছিল না।
বাঙালিরা যে চন্ডী, মনসা, শীতলা, লক্ষ্মী প্রভৃতি দেবতার পূজা করত তা কেবল পারলৌকিক প্রাপ্তির আশায় নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পার্থিব সমৃদ্ধি ও সুখশান্তি কামনায়। তাই অন্নদামঙ্গল কাব্যে নৌকার মাঝি ঈশ্বর পাটনি দেবীর নিকট আশীর্বাদ চেয়েছে: ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’। অধ্যাত্মবাদের পাশাপাশি বস্ত্তবাদী ও ভোগবাদী চিন্তাও যে বাঙালির ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত চৌদ্দ শতকের গৌড় পূর্ণানন্দ। তত্ত্বমুক্তাবলী-মায়াবাদ-শতদূষণী নামক গ্রন্থে তিনি যে দক্ষতার সঙ্গে শঙ্করের মায়াবাদ খন্ডণ করেছেন, তাতে আধুনিক বস্ত্তবাদী মনোবৃত্তির পূর্বাভাস বিদ্যমান।
বাঙালির দর্শনচর্চার প্রাচীনতম নিদর্শন হচ্ছে চর্যাপদ। চর্যাপদের পদগুলি বৌদ্ধ ধর্মমত ও দার্শনিক জিজ্ঞাসার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং গীতিধর্মী। এগুলিতে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এমন কিছু দুর্জ্ঞেয় তত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধুনিক দর্শনেরও উপজীব্য। সহজ সাধনার এসব গীতি থেকেই কালক্রমে বয়ে চলেছে বৈষ্ণব সহজিয়া গান, বৈষ্ণব ও শাক্ত পদাবলি, আউল-বাউল-মারফতি-মুর্শিদি গানের প্রবাহ। এগুলির অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ বাহ্য স্থূলার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রচলিত স্থূলার্থের আবরণে ধর্মসাধনার এবং জগৎ-জীবনভাবনার নিগূঢ় সংকেত নির্দেশ করাই ছিল এ গানগুলির উদ্দেশ্য।
চর্চাপদগুলির অধিকাংশই বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন প্রক্রিয়ার গূঢ়তত্ত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে। উল্লেখ্য যে, সহজিয়ারা বজ্রযানে বিধৃত তন্ত্রমন্ত্র, পূজা-পার্বণ ও আচার-অনুষ্ঠানে তেমন আস্থাশীল ছিলেন না। সম্প্রদায়গত নিষ্ঠার চেয়ে তাঁরা ব্যক্তিগত বোধ ও উপলব্ধির ওপর সমধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন। দেহসাধনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধিলাভের আকাঙ্ক্ষাই ছিল তাঁদের মধ্যে প্রবল। চর্যাপদে যে গূঢ় সাধনপদ্ধতির উল্লেখ দেখা যায়, তার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অধিবিদ্যক ব্যঞ্জনা পাশ্চাত্য দর্শনের কিছু কিছু প্রাচীন মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দর্শন কেবলই অধ্যাত্মমুখী।
আরও দেখুন: