বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা রচনাঃ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম ফার্স্ট লেডি এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এর স্ত্রী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে তার স্বামী, তিন পুত্র এবং দুই পুত্রবধূর সাথে হত্যা করা হয়।
Table of Contents
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা রচনা

সূচনাঃ
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নপুরুষ, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে মহীয়সী নারী সবসময়েই প্রেরণা যুগিয়েছেন, তিনি হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
যাকে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু বলে ডাককেন। তিনি ছিলেন ২ কন্যা এবং ৩ পুত্র সন্তানের জননী। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে শুধু বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে নয়, একজন নীরব সংগঠক হিসেবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হিমালয়সম আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
জন্ম ও পরিচয়ঃ
শেখ ফজিলাতুন্নেছার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম শেখ জহুরুল হক, মায়ের নাম হোসনে আরা বেগম। বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান ফজিলাতুন্নেছার গায়ের রং ফুলের মতো ছিল বলে মা তাঁকে ডাকতেন রেণু নামে। রেণুর বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়।
পিতামহ শেখ আবুল কাশেমের সিদ্ধান্তে তের বছর বয়সি চাচাত ভাই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তিন বছর বয়সে রেণুর বিয়ে দেওয়া হয়। রেণুর পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। সাত বছর বয়সে রেণুর দাদার মৃত্যু হলে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধুর মায়ের কাছে। বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন নিজের সন্তানদের সঙ্গে রেণুকেও সন্তানস্নেহে লালন-পালন করেন।
শৈশব ও কৈশোরঃ
শেখ ফজিলাতুন্নেছার শৈশব-কৈশোর কেটেছে টুঙ্গিপাড়ার প্রকৃতির কোলে; পাখি ডাকা, গাছগাছালি ঘেরা মধুমতী নদীর তীরে। শৈশব থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা, মানসিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রবণতা; প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গেই ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
পারিবারিক জীবনঃ
বেগম ফজিলাতুননেসা ছিলেন তার স্বামী শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাতো বোন । শেখ মুজিবের বয়স যখন ১৩ তখন বেগম ফজিলাতুন্নেসার বয়স মাত্র তিন বছর। পরিবারের বড়রা তখন তাদের বিয়ে ঠিক করেন। ১৯৩৮ সালে বিয়ে হবার সময় রেনুর বয়স ছিল ৮ বছর ও শেখ মুজিবের ১৮ বছর। পরে এই দম্পতির দুই কন্যা ও তিন ছেলে হয়। তারা হলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।

দৃঢ় মানসিকতাঃ
বঙ্গমাতা তাঁর সামগ্রিক জীবনাচরণের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনকে। সে জন্যই তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিতে পেরেছিলেন একজন লড়াকু, আদর্শ, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটানো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে নিজের সব চাওয়া-পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন দেশমাতৃকার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে। প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি ছিলেন দৃঢ় মানসিকতার অধিকারী। তাইতো, বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন তিনি আশা হারিয়ে ফেলেননি। সন্তানদের বুকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায়।
ত্যাগী মনোভাবঃ
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এক নাগাড়ে দুই বছরের বেশি সময় বঙ্গবন্ধু জেলের বাইরে থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বঙ্গমাতা সংসার সামলে পাঁচটি সন্তানকে মানুষ করেছেন। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, নানা রকম প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো, আর্থিক সহযোগিতা করা, সমস্যাসংকুল সময়ে আওয়ামী লীগকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করা, দলের আলোচনার সারাংশ কৌশলে জেলখানায় পৌঁছে দেওয়া; আবার বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে তুলে ধরা, বঙ্গবন্ধুর মামলার নথিপত্র সংরক্ষণ করা, মামলার খরচ যোগানোর জন্য প্রয়োজনে নিজের গয়না বিক্রি করা; এ সবই তিনি করেছেন নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও কর্মের ওপর আস্থা রেখে এ দেশের মানুষকে পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু সংসারে সময় দিতে পারেননি একেবারেই। বঙ্গমাতাই পালন করেছেন বঙ্গবন্ধুর যাবতীয় দায়িত্ব। পুত্রবধূ ও শ্বশুর-শাশুড়ির পারস্পরিক নির্ভরতার কথা আমরা জানি সেই টুঙ্গিপাড়ার কাল থেকেই। মূলত ফজিলাতুন্নেছাই হয়ে ওঠেছেন পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, আশ্রিতজনসহ বৃহৎ শেখ পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। দেবরের বিয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসা, ননদদের নানা সমস্যার সমাধান; সব কিছুর চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন ফজিলাতুন্নেছা।
অনুপ্রেরণা দানকারীঃ
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি পরামর্শ, সাহস আর অনুপ্রেরণা যুগিয়ে গেছেন আমৃত্যু। কোনো পদ-পদবির অধিকারী না হয়েও বঙ্গমাতা ছিলেন নারীর ক্ষমতায়নের এক অনন্য প্রতীক। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জাতির পিতার জন্য প্রেরণা, শক্তি ও সাহসের উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা।’
জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অনন্য ভূমিকার কথা আমরা বিশিষ্টজনদের স্মৃতিচারণা এবং লেখা থেকে জানতে পারি। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন।
কবির ভাষায় বলতে হয়-
কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয় লক্ষ্মি নারী।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং গবেষক ড. নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর লেখা ‘বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ বইটিতে লিখেছেন, “দৈহিক ও মানসিক সব কিছু নিয়েই বঙ্গবন্ধু ছিলেন আনন্দময় পুরুষ। আর এই আনন্দের উৎস তো ঘরের ভেতর ঘোমটার আড়ালে।গভীর আস্থা ছিল বঙ্গবন্ধুর রেণুর প্রতি। সংস্কৃত পণ্ডিতরা যাকে বলেছেন ‘সখা, সচিব’ রেণু ছিলেন তাই।

মহাকালের সাহসী নারীঃ
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে শুধু রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাই নয়, ফজিলাতুন্নেছা নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখে, প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছেন মমতাময়ী জননীর মতো। অসুস্থ মওলানা ভাসানীকে দেখতে ফলমূল, খাবার-দাবার নিয়ে ছুটে গেছেন হাসপাতালে। আবার খন্দকার মোশতাক জেলে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে লন্ডন পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন।
বেগম মুজিব কখনো কোনো দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। পরিচিত, অপরিচিত যে কেউ তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য এলে খালি হাতে ফিরে যায়নি কখনোই। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালে ফজিলাতুন্নেছার জেলখানায় খাবার পাঠানোটা ছিল বিশেষ আলোচনার বিষয়। বঙ্গবন্ধুর সহবন্দি কারও কিছু খেতে ইচ্ছে করলে বঙ্গবন্ধুকে তা জানানো হলে সে খবর পৌঁছে যেত বেগম মুজিবের কাছে।
আর বেগম মুজিব নিজ হাতে রান্না করে খাবার নিয়ে হাজির হতেন জেলখানায়। বঙ্গবন্ধু যখন কারামুক্ত হয়ে বাইরে অবস্থান করতেন, নেতাকর্মী,সাংবাদিকসহ নানা ধরনের লোকজনের আনাগোনায় তখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি সরগরম থাকত। এ বাড়ি থেকে কখনো কেউ খালি মুখে ফিরে যেতে পারত না।
প্রখর কৃতজ্ঞতাবোধঃ
বেগম ফজিলাতুন্নেছার চরিত্র মানবিকতা আর কৃতজ্ঞতাবোধের এক অনন্য উদাহরণ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ঘোষিত হলেও বেগম মুজিব পরিবারের সদস্যসহ ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মেজর তারার হস্তক্ষেপে বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্যরা ১৭ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। বঙ্গবন্ধুর জামাতা এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বর্ণনায় জানা যায় : দুই জন পাকিস্তানি সৈনিকের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ জামাল বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল সেই দুই জন সৈনিককে যেন কোনো রকম শাস্তি না দেওয়া হয়, সে জন্য বেগম মুজিব মেজর তারাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন।

উপসংহার:
বঙ্গবন্ধুর আজন্ম ছায়াসঙ্গী, সহযোদ্ধা, সকল অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা যে সম্মান আর ভালোবাসায় দুজন দুজনের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিলেন, ছিলেন পরস্পরের পরিপূরক, মৃত্যুকেও তাঁরা বরণ করে নিলেন একই সঙ্গে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তিনিও নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁদের সকলের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
আরও দেখুনঃ