ঈদুল ফিতর রচনা: দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মিলনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানুষকে উত্তীর্ণ করে যেকোনো উৎসব অনুষ্ঠান। মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব এই ঈদও তার ব্যতিক্রম নয়। ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো খুশি বা আনন্দ।
Table of Contents
ঈদুল ফিতর রচনা
সূচনা
হিজরী বর্ষপঞ্জী অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের পয়লা তারিখে এই ঈদ উল ফিতর অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়। তবে এই পঞ্জী অনুসারে কোন অবস্থাতেই রমজান মাস 30 দিনের বেশি দীর্ঘ হবে না। চাঁদ দেখার সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়াল মাসের প্রারম্ভ গণনা করা হয়। ঈদের আগের রাতকে ইসলামী পরিভাষায় লায়লাতুল জায়জা বলে অভিহিত করা হয়।
আধুনিককালে নানা আধুনিক পদ্ধতিতে ঈদের দিন নির্ধারিত হলেও আগে চাঁদ দেখা বা না দেখার উপর ঈদের দিন নির্ধারনের ভার ছিল। গোটা রমজান মাস ধরে রোজা পালন করা হয়।সূর্য ওঠা থেকে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত চলে নিরম্বু উপবাস। এই উপবাসের মধ্যেই চলে ব্যাস্ত জীবনের সব কাজকর্ম। সারাদিন ধরে উপবাস থেকে সূর্যাস্তের পর যখন রাত্রি নামে তখন চলে কোরান পাঠ ও শ্রবণ।
উৎসবের পর্যায়
পুরো একমাস ধরে এভাবে আত্ম শুদ্ধির পর বহু প্রত্যাশিত শওয়াল মাসে পবিত্র দিনে শুরু হয় ঈদ উল ফিতর অনুষ্ঠান পর্ব। মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত সব বয়সী নারী পুরুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে ঈদের আকলঙ্ক চাঁদ দর্শন করে প্রকাশ করে আনন্দ ও উল্লাস। ঈদের চাঁদ যখন আকাশ কে আলোকিত করে রাখে তেমনি প্রত্যেকের ঘরে ঘরে আলোর রোশনাই , ভালোবাসার উষ্ণতা সব মিলিয়ে ঈদ শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের সাথে সাথে সারা বিশ্বের হয়ে ওঠে।
সকাল থেকে সব মসজিদে নামাজ চলতে থাকে। খোদাতাল্লার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয় হৃদয় উজাড় করা বিনীত আকুতি ও গভীর শ্রদ্ধা ভক্তি। তারপর শুরু হয় মিলনের উৎসব। ধনী গরীব নির্বিশেষে একে অপরকে কোলাকুলি করে মানুষ মেতে ওঠে এই উৎসবে।
ঈদ উৎসবের তাৎপর্য:
ঈদ মুসলমান সম্প্রদায়ের সার্বজনীন উৎসব। মহরমও এই সম্প্রদায়ের আরও এক অন্যতম উৎসব।কিন্তু তা মুসলমান ধর্ম সম্প্রদায়ের এক বিশেষ গোষ্ঠীর অনুষ্ঠান। কিন্তু ঈদ হল এই সম্প্রদায়ের সকল মানুষের মিলনের অনুষ্ঠান। এর মুলে কোনো কঠোর ধর্মাচরণ নেই; বরং আছে আত্মশুদ্ধির দুশ্চর ব্রত। আল্লাহর কাছে শ্রদ্ধা নত চিত্তে আত্ম নিবেদনের প্রয়াস।
ঈদের সামাজিক প্রভাব:
অন্যান্য উৎসবের মতোই সামাজিক প্রেক্ষাপটে ঈদেরও বিশেষ প্রভাব রয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই উৎসব কোন কঠোর ধর্মাচরণের উৎসব নয়; এই উৎসব মিলনের। ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে আপন করে নেওয়ার। বিশ্বজুড়ে সামাজিক প্রেক্ষাপটে আজকের এই অস্থির সময়ে সকল ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে আপন করে নেওয়ার যে মহান তাৎপর্য রয়েছে তা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না।
বিশ্বজুড়ে বেঁচে থাকার ইঁদুর দৌড়ে মানুষকে টিকে থাকতে গেলে প্রত্যেক মুহূর্তে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেই সংগ্রামের একঘেয়েমি থেকে সামান্য মুক্তি নিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজের রুহ কে নিবেদিত করে সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার নামই ঈদ। রোজা রাখার মাধ্যমে শরীরের কঠোর আত্মত্যাগের দ্বারা ঘটে আত্মশুদ্ধি। তদুপরি সূর্যাস্তের পর রোজা ভেঙে দলবেঁধে ইফতার সামাজিক ভাতৃত্বের বন্ধনকেই সুদৃঢ় এ করে তোলে।
সবশেষে পবিত্র চাঁদ দেখা যাওয়ার পর উৎসবের ওই কয়দিনে মানুষ নিজের সকল কষ্টের কথা ভুলে মিলনের আনন্দে জীবনকে ভাসিয়ে দেয়। সমাজের মিলনের এই উৎসব মানুষকে সারা বছর জুড়ে জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। ঈদের ত্যাগে ধনীর দানে পূর্ণ হয় দরিদ্র। আল্লাহর তৈরি পৃথিবীতে সকলের বেঁচে থাকার সমান অধিকার আরো একবার সভ্যতার স্বীকৃতি পায়।
ঈদের অর্থনৈতিক প্রভাব:
শুনতে কিছুটা বেমানান লাগলেও প্রত্যেকটি উৎসবেরই একটি বৃহত্তর অর্থনৈতিক দিক রয়েছে। আমরা সবাই জানি অর্থনীতি ছাড়া এ পৃথিবী অচল। উৎসবগুলিও এর ব্যতিক্রম নয়। ঈদের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশ্বজুড়ে ঈদকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি মানুষ নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তারা অপেক্ষা করেন রোজার দিনগুলি তথা ইফতারের দিনগুলোর জন্য।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা দেখতে পাই রমজান মাসে বহু মানুষ ইসলামী পোশাকের দোকান দেন। কেউ কেউ কেউ ইফতারের জন্য তেলেভাজা বিক্রি করেন; কেউ বা ফল বিক্রি করেন, আবার কেউ সামান্য শরবত। এই প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে ঈদের ভূমিকা অসীম। আল্লাহর প্রতি নিবেদিত এই উৎসবের উপর নির্ভর করে তারা তাদের জীবন ও জীবিকার সংস্থান করে থাকেন।
তাছাড়া এই ঈদকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে মানুষের কেনাকাটা সার্বিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পায় আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য। আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বহু বড় বড় ব্যবসায়ী যেমন নির্ভর করেন; তেমনি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপ্ত এই ব্যবসাগুলির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে যুক্ত থেকে বহু মানুষ জীবন ধারণ করেন। ফলের ব্যবসা এই সময় বহুল পরিমাণে বেড়ে যায়। ফলে বৃহৎ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ফলচাষীরাও বিশেষভাবে উপকৃত হয়ে থাকেন।
আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ:
ঈদ হল মানুষের মিলনের উৎসব। এই উৎসবে ধনী-দরিদ্র আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে সকলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আত্মসমর্পণের উৎসবে যোগদান করে। বিশ্বজুড়ে পালিত এই উৎসব মানুষকে শেখায় ত্যাগ এবং ভ্রাতৃত্বর পালন। সারা পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মুসলমান একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিজেকে সমর্পণ করে।
একই দিনে একই সময়ে বিশ্বের প্রতিটি কোনায় একই সাথে সকল মুসলিমের এই সমর্পণ সমগ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ঐক্যের বোধ গড়ে তোলে। দেশ মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে একতার এই বাণী পৌঁছে যায় প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ। বহুল প্রচলিত প্যান-ইসলামিক ব্রাদারহুডের ধারণা এতে পূর্ণতা পায়।
উপসংহার:
ঈদ মানেই মুসলমান সম্প্রদায়ের সকল মানুষের মধ্যে সকল ভেদাভেদ ও শত্রুতা ভুলে বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করা। সকল প্রকার সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে সরিয়ে রেখে সকল মানুষকে আপন করে নেওয়া। তবে কিছু মানুষের ধর্মান্ধতার জন্য ইসলামের প্রকৃত মর্যাদা ও আদর্শ আজ গ্লানির সম্মুখীন হয়েছে। ধর্ম যে জগদ্দল পাথরের মতো স্থির কোন বস্তু নয় এই পরম সত্যকে আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
পাশাপাশি আমাদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে ধর্মান্ধতা যেন উৎসবের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধের মহান আদর্শকে গ্রাস না করে। বরং ভ্রাতৃত্ববোধ সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ বেড়া ডিঙিয়ে যদি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে সম্প্রসারিত হয়ে ঐক্যসূত্র গড়ে তুলতে পারে, তবে তাই হবে এই বিশ্বে পরিত্রাণের একমাত্র পথ।মধ্য যুগে কোন এক সুফী-সাধক একদিন বলেছিলেন “মহানবীর মহান আদর্শের পরম সত্যটুকুকে আমরা যদি যথাসাধ্য পালন করতে পারি, তবে তা হবে এ বিশ্বের মাটিতে জন্নত নেমে আসার সমতুল্য। আর যে ভূমিতে আদর্শের কোন স্থান নেই, শুধুই স্বার্থের বাড়াবাড়ি; সেই ভূমিই হল জাহান্নাম”।
ঈদুল ফিতর সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নোত্তর
প্রশ্নঃ ঈদুল ফিতর শব্দের অর্থ কি?
উত্তরঃ রোযা ভাঙ্গার আনন্দ
প্রশ্নঃ ঈদ মোবারক অর্থ কি?
উত্তরঃ ঈদ বা আনন্দ উদযাপন কল্যাণময় হোক
প্রশ্নঃ ঈদ কি?
উত্তরঃ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব
প্রশ্নঃ ঈদ কয়টি?
উত্তরঃ দুইটি ১.ঈদুল ফিতর ২. ঈদুল আযহা
প্রশ্নঃ ঈদুল ফিতর আরবি কোন মাসে হয়?
উত্তরঃ শাওয়াল মাসের ১ তারিখ
প্রশ্নঃ শাওয়াল হিজরি সনের কততম মাস?
উত্তরঃ দশম
প্রশ্নঃ ঈদের সালাত আদায় করার বিধান কি?
উত্তরঃ ওয়াজিব
প্রশ্নঃ প্রথম ঈদুল ফিতর কত সালে চালু হয়?
উত্তরঃ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে ৩০ মার্চ
আরও দেখুনঃ
- বাংলাদেশের খেলাধুলা রচনা । Essay on Sports of Bangladesh । প্রতিবেদন রচনা ও সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নোত্তর
- ঈদুল ফিতর