চরিত্র রচনা: প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের চিন্তায়, কর্মে, আচার-আচরণে নৈতিকতা তথা উৎকর্ষবাচক গুণের প্রকাশকেই চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, জীবনাচারে যদি আত্মমগ্নতা, স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা প্রকাশ পায় তবে তাকে চরিত্রহীন বলা হয়। চরিত্র মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে ।
Table of Contents
চরিত্র রচনা
ভূমিকা:
মানুষের আচার-আচরণ ও আদর্শের শ্রেয় ও উৎকর্ষবাচক গুণকেই চরিত্র বলা হয়। এটি মানব-ব্যক্তিত্বের এমন একটি শক্তি যা সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, নীতিপরায়ণতা ও নৈতিক মূল্যবােধের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। সচ্চরিত্রবান সত্যকথা ও সত্যচিন্তায় বিশ্বাসী, সকল অন্যায়-নিষ্ঠুরতার ঊর্ধ্বে তার অবস্থান। অন্যদিকে, দুশ্চরিত্রবানের অস্ত্রই হলাে মিথ্যাচার, মন্দ কাজ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি। মানবীয় গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এর মধ্যেই নিহিত থাকে মানুষের প্রকৃত পরিচয়।
চরিত্র কী:
ব্যক্তি বিশেষের গুণাবলিই চরিত্র। এটি ইংরেজি ‘Character’ শব্দের প্রতিশব্দ । বাংলায় চর’ (চলা) ধাতু থেকে শব্দটি গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ চরিত্র শব্দের সাথে গতির সম্পর্ক নির্দেশতি হয়েছে। মানুষের জীবনধারার গতির সাথেই চরিত্র- বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। চরিত্র’ শব্দটি ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়।
চরিত্রের বৈশিষ্ট্য:
চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয় ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক গুণ দিয়ে। নিম্নে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হলাে:
১. সত্য কথা বলা;
২. সত্য চিন্তা করা;
৩. সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমাশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা, মানবিকতা ইত্যাদি;
৪. হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা বর্জন;
৫. অন্তরশক্তির দৃঢ়তা;
৬. অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীনতা;
৭. গুরুজনে ভক্তি;
৮, আত্মসংযম, নিরহংকার, মানবপ্রেম;
৯. সামাজিক রীতি-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা;
১০. অধ্যবসায়, বিনয়, ধৈর্য, সৌজন্য, সৌভ্রাতৃত্ব;
১১. দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবােধ
এসব বৈশিষ্ট্যের আলােকে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন হয় বলে চরিত্রবান ব্যক্তি দেশ ও জাতির সম্পদ। এজন্যই মহানবি হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন,
‘তােমাদের মধ্যে সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।
চরিত্র গঠনের গুরুত্ব:
গঠনগত দিক থেকে চরিত্রের দুটি দিক- ১. সচ্চরিত্র, ২. দুশ্চরিত্র। ইতিবাচক গুণের সমন্বয়ে গঠিত হয় সচ্চরিত্র আর নেতিবাচক গুণ তথা পশুত্ব নিয়ে গঠিত হয় দুশ্চরিত্র। মানজীবনে চরিত্র গঠনের গুরুত্ব স্বল্প কথায় অপ্রকাশ্য। বিদ্যার চেয়ে চরিত্রের মূল্য অধিকতর। কেননা দুশ্চরিত্রবান বিদ্বান সমাজের বা দেশের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই করে বেশি।
অন্যদিকে, শুধু চরিত্রবলেই মানুষ হতে পারে বিশ্ববরেণ্য। অহিংস মনােভাব নিয়েই দেশ, জাতির কল্যাণ সম্ভব হয়। আর তা একমাত্র সচ্চরিত্রবানের পক্ষেই সম্ভব। তাই চরিত্র গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে একটা প্রচলিত সুভাষণ স্মরণযােগ্য:
‘অমরত্বের সুধা পান না করেও মানুষ অমর হতে পারে কেবল চরিত্রের গুণে।
চরিত্র গঠনের উপায়:
চরিত্র গঠনে ব্যক্তির নিজস্ব সাধনা যেমন প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন পারিপার্শ্বিক সহযােগিতা। মানুষের সম্পূর্ণ জীবনকালই চরিত্র গঠনের সময়। তবে শিশুবয়সই এর উৎকৃষ্ট সময়। তাই চরিত্র গঠনের প্রাথমিক পর্ব শুরু হয় নিজ পরিবারেই।
যেসব উপায়ে চরিত্র গঠন হতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে— ১. পরিবারের সহায়তায়, ২. সমাজের সহায়তায়, ৩. পরিবেশের সহায়তায়, ৪. ব্যক্তির নিজস্ব সাধনায়, ৫. শিক্ষার মাধ্যমে ।
চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা:
শিশুর চরিত্র গঠনে পরিবারই উপযুক্ত স্থান, শিশুরা অনুক্ৰণপ্রিয়। তাই বাবা-মা, ভাই-বােন, সঙ্গী-সাথি, আত্মীয়স্বজনের প্রভাব তাদের ওপর বেশি পড়ে। শিশুর সুসংহত ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্যে পরিবারের সবাইকে সচ্চরিত্রের গুণগুলাে চর্চা করতে হবে।বাস্তবসম্মতভাবে তাদেরকে নৈতিক উপদেশ দিতে হবে। ব্রাট্রান্ড রাসেল শিশুর চরিত্র গঠনে কতগুলাে বিষয়ের উল্লেখ করেছেনঃ-
১.সত্য কথা ও সত্য চিন্তায় অভ্যস্ত করতে
২.স্নেহ ও সমবেদনারশিক্ষা দিতে হবে।
৩.নৈতিক গুণাবলির অধিকারি হতে হবে।
৪.স্বার্থপরতা কীভাবে ক্ষতিকর তা বুঝিয়ে দিতে হবে
৫.অন্যায়-অত্যাচারের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে শিশুকে জানতে দিতে হবে। খুব কাছ থেকে শিশুকে নৈতিক চরিত্রের শিক্ষাদান পরিবারের পক্ষেই সম্ভব। আবার শিশুর চরিত্র বিকাশে পরিবারকে বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে সঙ্গ নির্বাচনে। কেননা সৎসঙ্গই শিশুর প্রতিভা বিকাশে সহায়ক।
অন্যথায় অকালেই অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে । সকল নিষ্ঠুরতা থেকে শিশুকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি সৃষ্টিশীল কাজে শিশুকে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবেই চরিত্র বিকাশে পরিবার পালন করে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে শিশুর চরিত্র গঠনে শিক্ষক-শিক্ষিকাও পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
চরিত্র গঠনে সমাজের ভূমিকা:
চরিত্র গঠনে সমাজের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বিশেষত শৈশবে চরিত্র বিকাশে সমাজ-পরিমণ্ডল পালন করে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা । পাড়া-প্রতিবেশী, সমবয়স্ক সঙ্গী-সাথি সবার সাথে মানবজীবন অতিবাহিত হয়। তাই এদের সবার প্রভাবেই গড়ে ওঠে ব্যক্তি চরিত্র ।
ফলে সামাজিক জীবনাচার যেন সৎ ও সুন্দর গুণাবলির সমন্বয়ে গঠিত হয় তার দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে সবাইকে। চরিত্র গঠনে পরিবেশের ভূমিকা: সুস্থ পরিবেশ মানুষের সুস্থ জীবনের ধারক। সুস্থ জীবনযাপনের মধ্যেই বিকশিত হয়। সুস্থ মন। সুস্থ মনই পারে সুন্দর ও কল্যাণের পূজা করতে। অর্থাৎ সুস্থ পরিবেশেই ঘটে সুস্থ মানসিকতার বিকাশ। সুস্থ মানসিকতা মানেই আনন্দপূর্ণ জীবন। তাই সচ্চরিত্র গঠনে পরিবেশের ভূমিকা অনবদ্য।
তাই পরিবেশ যাতে দূষিত না হয়, বিষন্ন না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে চরিত্র গঠনে ব্যক্তিসাধনা: চরিত্র গঠনে ব্যক্তিমনের দৃঢ়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়ােজনীয় চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে হল ব্যক্তির নিজের প্রতি সুদৃঢ় সম্মানবােধ থাকতে হবে। তবেই যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা ও অন্যায় নিষ্ঠুরতা থেকে সে নিজেকে সরিয়ে রাখার শক্তি অর্জন করবে।
নিজেকে যে সম্মান করতে পারে সে অপরের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। ফলে মানবিক মূল্যবােধই তার কাছে সর্বাগ্রে স্থান পায়। যা তার চরিত্রকে দেয় সুদৃঢ় ভিত্তি। তাই চরিত্রকে নির্মল, পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে মানুষকে আমৃত্যু কঠোর সাধনা করতে হয় ।
শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠন:
শিক্ষা শুধু জ্ঞানার্জনেই সহায়তা করে না, উন্নত চরিত্র গঠনেও সাহায্য করে। উন্নত চরিত্র গঠনের জন্যে প্রাণশক্তি, সাহস, সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধির সমন্বয় প্রয়ােজন। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলাের সঞ্চারণ করা হয়। পাঠ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর মনে সাবলীলভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগানাে হয় এবং জীবনীশক্তির সঞ্চার করা হয়। জীবনের প্রতি জাগ্রত আগ্রহ ব্যক্তির সুস্থ মানসিকতা গঠনে সহায়তা করে।
আবার শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফলে নিজের বিচার বিবেচনা দ্বারা আচরণবিধি তৈরি করে। আত্মবুদ্ধিতে পরিচালিত হওয়ার এ সাহস ব্যক্তিকে সচ্চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গড়ে তােলে। সংবেদনশীলতা ব্যক্তি চরিত্রর উল্লেখযােগ্য দিক । ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিই সংবেদনশীলতার যথার্থতা ।
যা ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবােধের জন্যে খুবই প্রয়ােজন। শিক্ষা মানুষের মননবিকাশের মাধ্যমে সংবেদনশীলতার যথার্থতা প্রদান করে। ফলে অমঙ্গলের প্রভাব থেকে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত রেখে।চারিত্রিক সমৃদ্ধি ঘটায়। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির বৌদ্ধিক বিকাশ সাধিত হয়। ব্যক্তি লাভ করে উদার দৃষ্টিভঙ্গি। চিন্তার ক্ষেত্রে এ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিকে ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সচেতন করে তােলে। এভাবেই শিক্ষা ব্যক্তির উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করে।
চরিত্রহীনতার কুফল:
মানব জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ চরিত্র। চরিত্রহীন ব্যক্তির মনে আশ্রয় নেয় পাশব চিন্তা। আত্মচিন্তায় বিভাের থাকে বলে চরিত্রহীন ব্যক্তি লােভ-লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে যেকোনাে পাপ কাজ করতে তার অন্তর কাপে না। তারা সমাজ ও দেশের কলঙ্ক। সবার ঘৃণাই তাদের পাথেয়। যতই বিত্তশালী হােক না কেন চরিত্রহীন মানুষ কখনােই কারও শ্রদ্ধা। ভালােবাসা পায় না। তাদের জীবন পশুর জীবনের চেয়েও নিকৃষ্ট।
মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত:
চরিত্রশক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তিগণ অমরত্ব নিয়ে মানব মনে বেঁচে থাকে চিরকাল। অন্যায়, অসত্য ও পাপের বিরুদ্ধে এসব মহৎ ব্যক্তিদের দৃঢ় অবস্থান অক্ষয় ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আলােকিত করে সবাইকে। তারা ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও গৌরবৌশ্বর্যে মহীয়ান। এমনই চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হজরত মুহাম্মদ (স.), যিশু খ্রিস্ট, গৌতমবুদ্ধ, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমােহন রায়, মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানী, হাজী মুহম্মদ মুহসীন প্রমুখ। এরা সবাই মানবব্রতী, দেশব্রতী, উন্নত ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী।
উপসংহার:
দিকে দিকে আজ অমঙ্গলের প্রভাব পরিলক্ষিত। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা যেন বিলুপ্ত। বিশ্বব্যাপী আজ বেড়েছে পরিভােগ প্রবণতা এবং কমেছে মূল্যবােধ। এমতাবস্থায় চরিত্রের নবজাগরণ একান্ত প্রয়ােজন। কেননা চরিত্রবান নাগরিকই অনৈতিকতার অন্ধকার থেকে জাতীয় জীবনকে রক্ষা করতে পারবে । চরিত্রের মহিমায় মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মূল্যবােধ | কবির কণ্ঠে মহৎ চরিত্র গঠনের বাণী শােনা যায়;
‘এমন জীবন হবে করিতে গঠন
মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’
আরও পড়ুনঃ
- শিশু শ্রম রচনা । Essay on Child labor । প্রতিবেদন রচনা
- মুক্তিযুদ্ধের রচনা । Essay on Liberation War । প্রতিবেদন রচনা ও সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নোত্তর
- বিজ্ঞাপন রচনা । Essay on Advertisement । প্রতিবেদন রচনা
- গণমাধ্যম রচনা । Essay on Mass media । প্রতিবেদন রচনা
- ক্রিকেট খেলা রচনা । Essay on Cricket game । প্রতিবেদন রচনা