বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা রচনা: বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে যেসব সমস্যা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জনসংখ্যা সমস্যা। একটি দেশে জনসংখ্যা জনশক্তি হিসেবে কাজ করে । রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকীয় উপাদানও জনসংখ্যা। কিন্তু জনসংখ্যা যখন। শক্তির বদলে সমস্যায় পরিণত হয় তখন দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের গতি হয়ে পড়ে মশ্বর।
Table of Contents
বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা রচনা
ভূমিকা :
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র একটি দেশ কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীতে এর অবস্থান প্রথম দশে । ক্ষুদ্রায়তনের এ দেশটিতে অতিরিক্ত জনসংখ্যায় ভার যেন অসহনীয় হয়ে উঠেছে । অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে দেশের আর্থ – সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে । জনসংখ্যার স্ফীতিরােধের কার্যকর উপায় দ্রুত উদ্ভাবন করা না গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য ।
সাম্প্রতিককালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রােধে কিছু ইতিবাচক সূচক লক্ষণীয় হয়ে উঠলেও সামগ্রিক অবস্থার বিস্তারে তা মােটেই কাক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছেনি । আমাদের প্রিয় ছােট্ট দেশটিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুখময় করে গড়ে তোলার জন্য সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে । এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি ।
জনসংখ্যা ও জনসংখ্যা সমস্যা :
একটি দেশের অধিবাসীদের সকলকে অর্থাৎ মােট মানুষের সংখ্যাকে জনসংখা বলে । কিন্তু ভূ – খণ্ডের আকৃতি এবং প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক সম্পদের সাথে জনসংখ্যার ভারসাম্য থাকা আবশ্যক । ভারসাম্যপূর্ণ জনসংখ্যাকে বলা হয় কাম্য জনসংখ্যা । জনসংখ্যা যখন কাম্য জনসংখ্যার চেয়ে বেশি হয় এবং অতিরিক্ত মানুষ সর্বক্ষেত্রে বিপত্তি সৃষ্টি করে , তখন জনসংখ্যা সমস্যার উদ্ভাব হয় । পৃথিবীর অনেক দেশেই জনসংখ্যার আধিক্যজনিত সমস্যা বিদ্যমান । তবে বাংলাদেশে এ সমস্যা সর্বাধিক প্রকট , যা জাতীয় জীবনে বহুবিধ সমস্যার জন্ম দিয়েছে ।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা পরিস্থিতি:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলােমিটার আয়তনের এই দেশ বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ।
প্রতি বর্গকিলােমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১০৩৫ জন , মাত্র দশ বছর আগেও যা ছিল প্রতি বর্গকিলােমিটারে ৯০৪ জন । বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৬ ( বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা -২০১৫ ) জনসংখ্যায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম , মুসলিম বিশ্বে চতুর্থ আর সার্কভুক্ত দেশসমূহে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় (বিশ্ব জনসংখ্যা রিপাের্টে ২০১৪ ) । আবার , নারী প্রতি প্রজননের জার ২.২০ জন ( বিশ্ব জনসংখ্যা রিপাের্ট ২০১৪ ) এবং শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩৩ জন ।
জাতিসংঘের তথ্য মতে , বর্তমানে ঢাকা বিশ্বের নবম মেগাসিটি । মেগাসিটি হলাে এক কোটি বা ১০ মিলিয়নের অধিক আনসংখ্যা অধ্যুষিত মেট্রোপলিটন এলাকা । জাতিসংঘের বর্তমান তথ্য মতে বর্তমান বিশ্বে মেগাসিটি ২১ টি । বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে কমলেও সেই চাপ এখনাে কমেনি । এই চাপের ফলশ্রুতিতে দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা , যা সমাধানকল্পে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের আর কোনাে বিকল্প নেই ।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব :
অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য দূর্বিষহ হয়ে দাড়িয়েছে । এরই পটভূমিতে সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে ঘােষণা করেছে । বাংলাদেশের পটভূমিতে জনসংখ্যাবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাবের বিভিন্ন দিক নিচে তুলে ধরা হলাে :
ক . দারিদ্র্য ও জীবনযাত্রার নিম্নমান :
সীমিত সম্পদের বিপরীতে অভিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে মানুষের ওপর দারিদ্র্য চেপে বসেছে । দেশের শতকরা ৩৭ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে ।
খ . খাদ্য ঘাটতি :
সাম্প্রতিক বছরগুলােতে দেশে উল্লেখযােগ্য পরিমাণ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও জনসংখ্যাবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হচ্ছে । ফলে খাদ্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না ।
গ . স্বাস্থ্যহীনতা ও পুষ্টি সমস্যা :
বিপুল জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা এ দেশের পক্ষে মােটেই সম্ভব হয়নি । শতকরা ৬০ ভাগ প্রসূতি ও শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার । সরকারি হাসপাতালে শয্যাপ্রতি জনসংখ্যা ১৬৫২ জন ।
ঘ . আবাসন সমস্যা :
আবাসন মানুষের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার । কিন্তু বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য ন্যূনতম আবাসন নিশ্চিত করা যায়নি । শুধু ঢাকা শহরেই অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ ফুটপাতে ও অন্যান্য স্থানে সম্পূর্ণ ভাসমানরূপে বসবাস করে । এখানে বস্তিবাসীর সংখ্যা ২৫ লাখ ।
ঙ . অশিক্ষা ও অজ্ঞতা :
বাংলাদেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার প্রায় ৭৩ শতাংশ । অবশিষ্ট ২৭ শতাংশ মানুষ আজও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত । অশিক্ষা ডেকে আনছে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ।
চ . বেকারত্বঃ
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে বাড়ছে বাংলাদেশের বেকারত্বও । কর্মক্ষম জনশক্তির প্রায় ৪৭ ভাগই বেকারত্বের শিকার । কারণ , ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করা সরকারে পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না ।
ছ . শিল্পায়নে পশ্চাদপদতা :
শিল্পায়নের পূর্বশর্ত মূলধন গঠন । মূলধন গঠনের জন্য মানুষের আয় বৃদ্ধি ও সঞ্চয়ের নিশ্চয়তা প্রয়ােজন । কিন্তু আমাদের দেশে দারিদ্র্যের কারনে মানুষের আয় নিম্ন, ফলে অনেকের পক্ষেই সঞ্চয় করা সম্ভব হয়না । ফলে মূলধনও গঠিত হয় না । ফলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ঘোচানাে সম্ভব হয় না ।
জ . উন্নয়নের ধীরগতি :
বিরাটসংখ্যক নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণেই রাষ্ট্রের অর্থ সংকুলান হয় না । ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থের সংস্থান করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় । তাই ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋনগ্রহণ করতে হয় । এ ঋণ পরিশােধের জন্য দেশের মানুষের আয় অন্যের হাতে তুলে দিতে হয় । ফলে আর্থ – সামাজিক ও অবকাঠামােগত ক্ষেত্রে কাক্ষিত গতি অর্জন করা যায়নি।
ঝ . সামাজিক সমস্যা :
অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের সকল প্রকার সামাজিক সমস্যার মূল রূপে চিহ্নিত । সন্ত্রাস , আইন – শৃঙ্খলার অবনতি , ঘুষ – দুর্নীতি , পতিতাবৃতি , মূল্যবােধের অবনতি , অপসংস্কৃতির প্রসার , শ্রেণিবৈষম্যজনিত সামাজিক সংঘাত , ভিক্ষাবৃত্তি , পরনির্ভরশীলতা , শিশুশ্রম প্রভৃতির মতাে সামাজিক সমস্যা আমাদের দেশকে জর্জরিত করে তুলেছে জনসংখ্যাধিক্যের কারণেই
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ :
বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যাবৃদ্ধির পেছনে কিছু কারণ শনাক্ত করা হয়েছে । তা হলাে :
১. ভৌগােলিক পরিবেশ
২ . শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব
৩ . ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কার
৪ . দারিদ্র্যের আধিক্য
৫ . চিত্তবিনােদন ও মননশীলতার সীমিত সুযােগ
৬ . বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ
৭ . জন্মহার ও মৃত্যুহারের ব্যবধান
৮ . ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব
৯ . জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অজ্ঞতা
১০. আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ।
সমস্যা সমাধানে প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ ও গৃহীত পদক্ষেপ :
দিনে দিনে জনসংখ্যা সমস্যা যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে , তা সমাধানের কোনাে নির্ভরযােগ্য উদ্যোগ গৃহীত হয়নি । গােটা বিশ্বই আজ জনসংখ্যা সমস্যার শিকার । তাই বিশ্ব মানবতার কল্যাণে জাতিসংঘের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে । বাংলাদেশে সরকারও জনসংখ্যা সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্দি করেছে । জন্মহার রােধ , খেতখামার ও কল – কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে সরকার দ্বিমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । একই সঙ্গে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমানাের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাগুলাে অবলম্বন করলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে :
১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন
২. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা
৩. যথাসময়ে বিবাহ এবং বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথার অবসান
৪. শিক্ষার বিস্তার
৫. নারীশিক্ষার প্রসার
৬. আইন প্রণয়ন ও আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার
৭. আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা
৮. জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা
৯. বেকারত্ব দূর করা
১০. গণমাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে প্রচার
১১. সর্বোপরি প্রচার – প্রসার ও সচেতনতার মাধ্যমে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ।
উপসংহার :
অ্যারিস্টটল বলেছেন ,
” Optimum population is a boon , over population is a bane . “
তাই বাংলাদেশের মতাে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের একটি দেশকে আত্মনির্ভরশীল উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে হবে । জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি খুব দ্রুত বাস্তবায়িত না হলে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের অভিশাপ থেকে এই দেশ কখনােই মুক্ত হবে না । আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এই স্লোগান ,
“ ছেলে হােক মেয়ে হােক , দুটি সন্তানই যথেষ্ট ,
দুটি সন্তানের বেশি নয় , একটি হলে ভালাে হয়”
জনসংখ্যা সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নোত্তর
১.বিশ্বের মোট জনসংখ্যা কত?
-৭৭৯.৫০ কোটি।
২.বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কত?
-১.১%।
৩.জনসংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম দেশ কোনটি?
-চীন।
৪.জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক কোন দেশে?
-বাহরাইন।
৫.জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম কোন দেশে?
-লিথুয়ানিয়া।
৬.নারী প্রতি সর্বাধিক প্রজনন হারের দেশ কোনটি?
-নাইজার।
৭.সার্কভুক্ত কোন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বাধিক?
-মালদ্বীপ।
৮.সার্কভুক্ত কোন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম?
-শ্রীলংকা।
৯.বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত?
-১৬.৪৭ কোটি।
১০.গড় আয়ুতে শীর্ষ দেশ কোনটি?
-হংকং।
১১.বিশ্বের জনসংখ্যার গড় আয়ু কত?
-৭২.৬ বছর।
১২.বিশ্বের জনসংখ্যার মাথাপিছু আয় কত?
-১৫,৭৪৫ মার্কিন ডলার।
১৩.মানব উন্নয়ন রিপোর্ট ২০১৯ সূচকে শীর্ষ ও সর্বনিম্ন দেশ কোনটি?
-শীর্ষ দেশ নরওয়ে ও সর্বনিম্ন দেশ নাইজার।
১৪.মানব উন্নয়ন রিপোর্ট ২০১৯ অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান কততম?
-১৩৫ তম।
আরও পড়ুনঃ