বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ | লাল নীল দীপাবলি | হুমায়ুন আজাদ | বাংলা প্রস্ততি

বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ : দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রচিত হচ্ছে বাঙলা সাহিত্য। তাই বাঙলা সাহিত্যের বয়স এক হাজার বছরেরও বেশি। এ-সময়ে সৃষ্টি হয়েছে সুবিশাল এক সাহিত্য। সাহিত্য নানা সময়ে নানা রূপ ধারণ করে। কালে কালে নতুন হয়ে সামনের দিকে এগোয় সাহিত্য। হাজার বছরে বাঙলা সাহিত্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক নিয়েছে, এ বাঁকগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট। হাজার বছরের বাঙলা সাহিত্যকে ভাগ করা হয় তিনটি যুগে।

বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ | লাল নীল দীপাবলি | হুমায়ুন আজাদ | বাংলা প্রস্ততি
হুমায়ুন আজাদ, ১৯৪৭-২০০৪ [ Humayun Azad ]

বাঙলা সাহিত্যের তিন যুগ :

[ক] প্রাচীন যুগ : ৯৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত।

[খ] মধ্যযুগ: ১৩৫০ থেকে ১৮০০ পর্যন্ত।

(গ) আধুনিক যুগ : ১৮০০ থেকে আজ পর্যন্ত, আরো বহুদিন পর্যন্ত।

এ-তিন যুগের সাহিত্যই বাঙলা সাহিত্য, কিন্তু তবু বিষয়বস্তুতে, রচনারীতিতে এ-তিন যুগের সাহিত্য তিন রকম। প্রাচীন যুগে পাওয়া যায় একটি মাত্র বই, যার নাম চর্যাপদ। এর ভাষা আজ দুর্বোধ্য, বিষয়বস্তু দুরূহ। এর কবিরা সকলের জন্যে সাহিত্য রচনা করেন নি, করেছেন নিজেদের জন্যে। তাছাড়া সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্যও হয়তো তাঁদের ছিলো না। তাঁরা সবাই ছিলেন বৌদ্ধ সাধক; তাঁরা এ কবিতাগুলোতে নিজেদের সাধনার গোপন কথা বলেছেন। তবু মনের ছোঁয়ায় তাতে লেগেছে সাহিত্যের নানা রঙ ও সৌরভ।

এর পরে দেড়শো বছর বাঙলা ভাষায় আর কিছু রচিত হয় নি। কালো, ফসলশূন্য এ-সময়টিকে [১২০০ থেকে ১৩৫০] বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। কেননা এ সময়ে আমরা কোনো সাহিত্য পাই নি। অন্ধকার যুগের পরে পুনরায় প্রদীপ জ্বলে, আসে মধ্যযুগ। এ-যুগটি সুদীর্ঘ। এ সময়ে রচিত হয় অসংখ্য কাহিনীকাব্য, সংখ্যাহীন গীতিকবিতা; মানুষ আর দেবতার কথা গীত হয় একসাথে। আগের মতো সাহিত্য আর সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে নি, এর মধ্যে দেখা দেয় বিস্তার। এর ফলে সাহিত্যে স্থান পায় দেবতা ও দৈত্য, মানুষ ও অতিমানুষ; আসে গৃহের কথা, সিংহাসনের কাহিনী।

এ-সময়ে যাঁরা মহৎ কবি, তাঁদের কিছু নাম : বড় চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, ভারতচন্দ্র, আলাওল, কাজী দৌলত। মধ্যযুগের একশ্রেণীর কাব্যকে বলা হয় ‘মঙ্গলকাব্য’। এগুলো বেশ দীর্ঘ কাব্য। কোনো দেবতার মর্ত্যলোকে প্রতিষ্ঠার কাহিনী এগুলোতে বলেন কবিরা। এজন্যে মঙ্গলকাব্য দেবতাদের কাবা। মধ্যযুগের সকল সাহিত্যই দেবতাকেন্দ্রিক, মানুষ সে সময়ে প্রাধান্য লাভ করে নি। মানুষের সুখদুঃখের কথা এসেছে দেবতার কথাপ্রসঙ্গে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না, কেননা দেবতার ছদ্মবেশে এ-সব কাব্য জুড়ে আছে মানুষ।

লাল নীল দীপাবলি, বাংলা সাহিত্যের জীবনী [ Lal Nil Dipaboli ] প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বাংলা প্রস্তুতি
লাল নীল দীপাবলি, বাংলা সাহিত্যের জীবনী [ Lal Nil Dipaboli ]
মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ ফসল বৈষ্ণব পদাবলি। এ-কবিতাগুলো ক্ষুদ্র; কিন্তু এগুলোতে যে আবেগ প্রকাশিত হয়েছে, তা তুলনাহীন। এ-কবিতার নায়কনায়িকা কৃষ্ণ ও রাধা। বৈষ্ণব কবিরা কখনো রাধার বেশে কখনো কৃষ্ণের বেশে নিজেদের হৃদয়ের আকুল আবেগ প্রকাশ করেছেন এ-কবিতাগুলোতে। মধ্যযুগে মুসলমান কবিরা একটি নতুন প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন। তাঁরা সর্বপ্রথম শোনান নিছক মানুষের গল্প। মধ্যযুগে হিন্দু কবিরা দেবতার গান ও কাহিনী রচনায় যখন সমর্পিত, তখন মুসলমান কবিরা ইউসুফ-জুলেখা বা লাইলি-মজনুর হৃদয়ের কথা শোনান। এর ফলে দেবতার বদলে প্রাধান্য লাভ করে মানুষ। এ-মানুষ যদিও কল্পনার সৃষ্টি, তবু মানুষের কথা সবার আগে বলার কৃতিত্ব মুসলমান কবিরা দাবি করতে পারেন।

মধ্যযুগের অবসানে আসে আধুনিক যুগ, এইতো সেদিন, ১৮০০ অব্দে। আধুনিক যুগের সব চেয়ে বড়ো অবদান গদ্য। প্রাচীন যুগে, মধ্যযুগে বাঙলা সাহিত্যে গদ্য বলতে বিশেষ কিছু ছিলো না। তখন ছিলো কেবল কবিতা বা পদ্য। তখন গদ্য ছিলো না, তা নয়; গদ্যসাহিত্য ছিলো না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকেরা সুপরিকল্পিতভাবে বিকাশ ঘটান বাঙলা গদ্যের। তাঁদের প্রধান ছিলেন উইলিয়ম কেরি। কেরির সহায়ক ছিলেন রামরাম বসু। উনিশশতকের প্রথম অর্ধেক কেটেছে সদ্য জন্মনেয়া গদ্যের লালনপালনে।

হুমায়ুন আজাদ, ১৯৪৭-২০০৪ [ Humayun Azad ]
হুমায়ুন আজাদ, ১৯৪৭-২০০৪ [ Humayun Azad ]
বিভিন্ন লেখক নিজ নিজ ভঙ্গিতে গদ্য রচনা করেছেন, আর বিকশিত হয়েছে বাঙলা গদ্য। সে-সময়ের যাঁরা প্রধান গদ্যলেখক, তাঁরা হচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত। গদ্যের সাথে সাহিত্যে আসে বৈচিত্র্য; উপন্যাস দেখা দেয়, রচিত হয় গল্প নাটক প্রহসন প্রবন্ধ আরো কতো কী। প্রথম উপন্যাস লেখেন প্যারীচাঁদ মিত্র; উপন্যাসের নাম আলালের ঘরের দুলাল। মহাকাব্য রচনা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। নাম মেঘনাদবধকাব্য।

মধুসূদন দত্ত আধুনিক কালের একজন মহান প্রতিভা। তাঁর হাতে সর্বপ্রথম আমরা পাই মহাকাব্য ও সনেট, পাই ট্রাজেডি, নাম কৃষ্ণকুমারীনাটক। পাই প্রহসন, নাম বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা। এরপরে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ। তারপর আসেন মোহিতলাল মজুমদার, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং আরো কতো প্রতিভা। তাঁরা সবাই বাঙলা সাহিত্যকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে গেছেন।

আরও দেখুন:

লাল নীল দীপাবলি | হুমায়ুন আজাদ | বাংলা প্রস্ততি

Leave a Comment