শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay । প্রতিবেদন রচনা ও সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নোত্তর

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনার নমুনা তৈরি করবো আমরা আজ শিক্ষার্থীদের জন্য। বাংলা কথা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের পরেই যাঁর নামটি মনে পড়ে যায়, তিনি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি পাঠকগণের কাছে কথা সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত।পাঠক হৃদয়ে তাঁর যথার্থ স্থান।সাহিত্য ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ পাঠকদের মনে তিনি নিজ মহিমায় আসীন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay

ভূমিকা:

কথার জাল বুনে সমাজের অবহেলিত মানুষের সমস্যা নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন দরদী কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের পর যে নামটি স্বাভাবিকভাবে মনে উঁকি দেয়, তিনি হলেন অপরাজেয় এই কথাশিল্পী।

জন্ম ও শৈশব:

হুগলী জেলায় দেবানন্দপুর গ্রামের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২৮৩ সালের ৩১শে ভাদ্র) শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতার নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবকালে পিতার কাছ থেকে তিনি সাহিত্যসাধনার অনুপ্রেরণা পান।

তাঁর বাল্যকাল ও পাঠ্যজীবনের প্রথমাংশ কাটে গ্রামে। অভাব-অনটনের কারণে বিহারের ভাগলপুরের মামাবাড়িতে সপরিবারে চলে আসেন তাঁরা। ছোটো থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন শরৎচন্দ্র।

দারিদ্রের সংসারে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছিলেন। শেষে এফ.এ পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় তাঁর পাঠ্যজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। শরৎচন্দ্র আশৈশব ভবঘুরে ছিলেন। এরই মধ্যে তিনি ছদ্মনামে বেশ কয়েকটি গল্প লেখেন।

 

যৌবন-জীবিকা ও সাহিত্য:

যৌবনে জীবিকার তাগিদে বহুদিন রেঙ্গুনে কাটিয়েছিলেন। সেখানে এক কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অনুরোধে শরৎচন্দ্র বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম হিরণ্ময়ী দেবী। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি কুন্তলীন পুরষ্কারপ্রাপ্ত ‘মন্দির’ গল্পটি লেখেন। রেঙ্গুনে থাকার সময় কিংবা মাঝেমধ্যে কলকাতায় এলে তিনি পরিচিতদের অনুরোধে বেশ কিছু গল্প লেখেন। সাহিত্যের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হবার পর তিনি পাকাপাকিভাবে বঙ্গে ফিরে আসেন। বাসা বাধেন কখনও হাওড়ায়, কখনো পাণিত্রাসে কখনো বা কলকাতায়। প্রকাশকের অনুরোধে লেখালেখি জারি থাকে।

শরৎসাহিত্য:

শরৎচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস বড়দিদি ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একে একে বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, পরিণীতা, বৈকুণ্ঠের উইল, পল্লীসমাজ, দেবদাস, চরিত্রহীন, নিষ্কৃতি, শ্রীকান্ত, দত্তা, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন ইত্যাদি গল্প-উপন্যাস এবং নারীর মূল্য, স্বদেশ ও সাহিত্য প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেনা-পাওনা এবং পথের দাবী খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর পথের দাবী উপন্যাসটি তৎকালীন বিপ্লবীদের সমর্থনের অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর শরৎচন্দ্র ও ছাত্রসমাজ, ছেলেবেলার গল্প, শুভদা, শেষের পরিচয়, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থাবলী এবং শরৎচন্দ্রের অপ্রকাশিত রচনাবলী প্রকাশিত হয়। তাঁর বহু সাহিত্যকর্ম চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay

শরৎসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য:

শরৎচন্দ্র ঔপন্যাসিক, অমর কথাশিল্পী, নিপীড়িত দরিদ্রদের জীবনকে সাহিত্যে তুলে এনেছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে অসহায় দুর্বল তথাকথিত সমাজ পতিতাদের দুঃখ-দুর্গতি ও নানা সমস্যার ছবি এঁকেছেন পরম মমতা দিয়ে। সমাজের কুসংষ্কার, অন্যায় অবিচার, জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।

তিনি সমাজের সব স্তরের মানুষের কথা বলত। তাঁর উপন্যাসের একদিকে যেমন সমাজের নিপীড়নের বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে সেইসময়কার নারীজাতির অসহায়তার কথা যত্নশীল ভাবে তুলে ধরেছেন। শরৎসাহিত্যে নারীচরিত্ররা পুরুষচরিত্রের থেকে বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর লেখায় নারীজাতিকে উচ্চাসনে বসিয়েছেন তিনি।

কিরণময়ী, সাবিত্রী, রাজলক্ষ্মী, ষোড়শী, চন্দ্রমুখী প্রমুখ নারীচরিত্রগুলি নিজ মহিমায় উজ্জ্বল এবং তাদের চরিত্রের বিভিন্ন দিক বিকশিত। শরৎচন্দ্র নারীর সতীত্বের চেয়ে নারীত্বকে মর্যাদা দিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে শরৎচন্দ্র নারীজাতিকে সম্মান করত। বিধবাদের প্রতি ছিল তাঁর সমবেদনা।

চিত্রশিল্পী:

শরৎচন্দ্র চিত্রাঙ্কণে দক্ষ ছিলেন। বার্মায় বসবাসকালে তাঁর অঙ্কিত ‘মহাশ্বেতা’ অয়েল পেইন্টিংটি বিখ্যাত।

রাজনীতিতে শরৎচন্দ্র:

হাওড়ার বাজে শিবপুরে থাকাকালে ১৯২১ খ্রীস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে শরৎচন্দ্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে কংগ্রেসে যোগ দেন। হাওড়ায় থাকতেন বলে তাঁকে হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি করা হয়। ১৯২১ থেকে ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত একটানা দীর্ঘ ১৬ বছ র তিনি হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। শরৎচন্দ্র ভারতের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগ্রামী বা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন। বিপিন গাঙ্গুলী সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের মামা হতেন। শরৎচন্দ্র বহু বিপ্লবীকে অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছেন।

শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ:

বাজে শিবপুরে থাকার সময়েই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। শরৎচন্দ্রের বাল্যবন্ধু ঔপন্যাসিক চারু বন্দোপাধ্যায় তাঁকে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শরৎচন্দ্র বিচিত্রার আসরে তাঁর বিলাসী গল্পটি পড়েছিলেন। পরে নানা প্রয়োজনে শান্তিনিকেতনে ও জোড়াসাঁকোয় কবির কাছে গেছেন। শরৎচন্দ্রের সাথে লেখিকা রাধারাণী দেবীর অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল।

পুরস্কার:

সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য শরৎচন্দ্র কুন্তলীন পুরস্কার (১৯০৩), জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯২৩), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাম্মানিক সদস্যপদ (১৯৩৪) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি (১৯৩৬) লাভ করেন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা । Essay on Sarat chandra Chattopadhay

মৃত্যু:

এই দরদী সাহিত্যিকের শেষজীবনে যকৃতে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসা চলছিল তাঁর। অস্ত্রোপচারের চারদিন পর ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৩৮ সকাল দশটায় কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬১ বছর। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে বলেন- “যিনি বাঙালীর জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি।”

উপসংহার:

বর্তমানে কথাসাহিত্যকে বলা হয় ‘গণসাহিত্য’। সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের জীবনচিত্র সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যের উপজীব্য। শরৎচন্দ্রের কথাসাহিত্য হল আজকের গণসাহিত্যের পূর্বপুরুষ। তাঁর মাধ্যমেই গণসাহিত্যের অবতারণা। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর অমর সৃষ্টি দিয়ে পাঠকের মনে তিনি চির-আসীন।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত গল্পের নাম কি?

উত্তর : “ মন্দির ”।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম কি?

উত্তর : অনিলা দেবী।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্রের ডাকনাম কি ছিলাে?

উত্তর : শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিলাে ন্যাড়া ।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতার নাম কি?

উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায়।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মায়ের নাম কি?

উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মায়ের নাম ভুবনমােহিনী দেবী ।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবে মৃত্যু হয়?

উত্তর : শরৎচন্দ্র ১৯৩৮ সনের ১৬ ই জানুয়ারি কলকাতায় অমৃতলােকে যাত্রা করেন ।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রেঙ্গুনে কবে যান?

উত্তর : ১৯০৩ সালে শরৎচন্দ্র জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গুনে যান ।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কি নামে পরিচিত?

উত্তর : কথাশিল্পী।

প্রশ্ন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দাম্পত্যসঙ্গী কে ছিলেন?

উত্তর : শান্তি দেবী, হিরন্ময়ী দেবী।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment