সুরঞ্জনা কবিতা – জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা কবিতাটি জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ এর একটি বিখ্যাত কবিতা। জীবনানন্দ দাশ (১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৯ – ২২ অক্টোবর, ১৯৫৪; ৬ ফাল্গুন, ১৩০৫ – ৫ কার্তিক, ১৩৬১ বঙ্গাব্দ) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। তার কবিতায় পরাবাস্তবের দেখা মিলে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী।

সুরঞ্জনা কবিতা - জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ

সুরঞ্জনা কবিতা

সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে
কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? —গিয়েছে হারায়ে।

বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের
ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;
তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা;
একটি পাখির গান কী রকম ভালো।
মানুষ কাউকে চায়— তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।

মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে
ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে
উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে
তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে
সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়,
আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।

যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা
মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে
ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে
আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;
তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল
দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।

Competitive Exams Preparation Gurukul, GOLN Logo [ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি গুরুকুল, লোগো ]

সুরঞ্জনা কবিতার বিশ্লেষণ:

রাফি নামের একজন বিশ্লেষক সচলায়তন ব্লগে কবিতাটি বিশ্লেষন করতে গিয়ে লিখেছেন:

বেশিরভাগ বাঙ্গালীই এ কবিতার অন্তত দুটি লাইন শুনেছেন। “সুরঞ্জনা অইখানে যেওনাকো তুমি, বলোনাক কথা অই যুবকের সাথে” আমার মতে বাংলা কবিতার সর্বাধিক পঠিত,সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এবং দূর্ভাগ্যবশত সবচেয়ে কম বিশ্লেষিত পংক্তি। বহুব্যবহারে আবেদন হারিয়ে ফেলা, আবেগের উচ্ছাসে বিবেচনাবোধ কাড়তে ব্যর্থ হওয়া এই “আকাশলীনা” কবিতাটি নিয়েই আজ কিছু কথা।যারা কবিতাটিকে হৃদয় এবং বুদ্ধি দিয়ে নিজের ভেতর ধারণ করেছেন তারা তাদের ভাবনাটুকু আমাকে জানালে এবং যারা কবিতাটিকে নিতান্তই ত্রিভূজ প্রেমের কবিতা হিসেবে মনে করেছেন অথবা করছেন তারা একটু নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে কবিতাটিকে দেখলে বাধিত হব। কবিতাটি গত একমাস ধরেই আমাকে বেশ ভোগাচ্ছে।

—–
সুরঞ্জনা ,অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;

ফিরে এসো এই মাঠে , ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূর – আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

কী কথা তাহার সাথে? -তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মত তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস:
বাতাসের ওপারে বাতাস-
আকাশের ওপারে আকাশ।
(আকাশলীনা – জীবনানন্দ দাশ)
——-

আপাতদৃষ্টিতে কবিতাটি বিস্ময়কররকম সরল। জীবনানন্দীয় দূর্বোধ্যতা, অদ্ভুত উপমার আরো ততধিক অদ্ভুত প্রয়োগ, “মতো” শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার, ইতিহাসঘনিষ্ঠ দুঃসাহসী চিত্রকল্প, মৃত্যু আর অন্ধকারের ব্যতিক্রমী বন্দনা এককথায় সকল জীবনানন্দীয় অনন্যতা থেকে এটি প্রথমদর্শনে মুক্ত বলেই মনে হয়।স্পষ্টতই শাশ্বত প্রেমের চিরায়ত সংগী বিরহ অথবা বিরহবিষয়ক কবিতা এটি।কবিতার পাত্র-পাত্রী তিনজন- কবি নিজে , সুরঞ্জনা এবং জনৈক যুবক; অর্থাৎ সেই আমি, তুমি ও সে। আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে সুরঞ্জনা অনেকদূরে হারিয়ে গেছে আর নক্ষত্রের রুপালী আগুনভরা রাতে আমি তাকে আবার ফিরে আসতে আহবান করছি -কবিতাটির কবি কে এটা না বলে দিলে যে কেউ এই ব্যখ্যাটিই দাঁড় করাবেন; আসলে সাধারণভাবে এর বাইরে বেশি কিছু মনে হয়ও না।

কিন্তু এই সরলীকৃত ব্যাখ্যায় বাদ সাধে কবির নাম, তার অপরাপর কবিতা(ভুলে গেলে চলবে না এই কাব্যগ্রন্থটি কবির পরিণত বয়সের রচনা এবং এতেই রয়েছে জীবনানন্দের দূর্বোধ্যতম কবিতা “গোধূলিসন্ধির নৃত্য”) । আরেকটু তলিয়ে দেখলে আলোচ্য কবিতার কয়েকটি পংক্তি এবং শব্দও কিছু জবাব না জানা প্রশ্নের জন্ম দেয়ঃ

১) সুরঞ্জনা কি কারো নাম নাকি নামবিশেষণ?
২) কবি ঐখানে এবং ঐ যুবকের কথা না বলে “অইখানে” ও “অই যুবকের” কথা কেন বললেন?
৩) জীবনানন্দ একই লাইনে “তাহার সাথে” এবং “তার সাথে” দুই ধরণের সর্বনাম কেন ব্যবহার করলেন?
৪)মৃত্তিকার মতো প্রিয়া আর ঘাস হয়ে যাওয়া প্রেম(শেষ স্তবকে হৃদয়) চিত্রকল্পটির মাধ্যমে তিনি আসলে কী বুঝাতে চাইছেন?
৫) কবিতাটির শিরোনামটির মাজেজাই বা কী? (জীবনানন্দের প্রায় সব কবিতার শিরোনামই কবিতায় ব্যবহৃত কোন শব্দ থেকে নেয়া, কিন্তু লক্ষ্যনীয় “আকাশলীনা” শব্দটি মূল কবিতায় একবারও ব্যবহার হয় নি)

প্রথমেই বলে রাখি আমি বোদ্ধা নই, সমালোচকতো নই- ই। আমি জীবনানন্দের একজন সচেতন পাঠকমাত্র। জীবনানন্দ গবেষক ও সমালোচকদের বক্তব্য পাঠ করে আমার কাছে মনে হয়েছে কবিতাটি ততটা সরল নয়- যতটা প্রথম পাঠে মনে হয়। সুরঞ্জনা শব্দটির অর্থ আমি কোথাও খুঁজে পাই নি- এক জায়গার এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে বন্দিনী রাজকন্যা(প্রসঙ্গত বলে রাখি “কবিতা”পত্রিকায় প্রকাশের সময় কবিতাটিতে সুরঞ্জনা শব্দটির বদলে “হৈমন্তিকী” শব্দটি ছিল; কবিতার শিরোনাম ছিল“ ও হৈমন্তিকী”) এদিক থেকে বলতে হয় সুরঞ্জনা শব্দটি এ কবিতায় নায়িকার রুপকমাত্র, নায়িকার নাম নয় কোনভাবেই। ঐখানের পরিবর্তে অইখানে ব্যবহার হয়েছে শুধুমাত্র দূরত্বটুকু অনির্দিষ্ট করে দেবার স্বার্থেই, স্পষ্টতই অই শব্দটি ঐ এর চেয়ে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা নির্দেশ করে। অনুরুপভাবে যুবকের নির্দেশক হিসেবে “অই” এর ব্যবহার যুবকটিকে অনির্দিষ্ট এবং একইসাথে যুবকটির সাথে কবির অপরিচিতি নির্দেশ করে।

এখন কথা হচ্ছে যেহেতু যুবকটি অপরিচিত তাই “তাহার” ব্যবহার যুক্তিযুক্ত কিন্তু কোন যাদুবলে ঠিক পরমুহূর্তেই যুবকটি কবির এত কাছের হয়ে যায় যে তিনি তাকে “তার” বলে সম্বোধন করেন? অন্যদিকে মৃত্তিকার সাথে ঘাসের অন্তরংগতা সুরঞ্জনার সাথে যুবকের অভিসার বর্ণনা করে এটা ধরে নিতে কোন বাধা নেই কিন্তু সর্বশেষ স্তবকে কেন সুরঞ্জনার হৃদয় ঘাস হয়ে গেল আর শেষ দুলাইনে কেনই বা বেজে উঠল হাহাকার?

এই দুটি প্রশ্নের ব্যাখ্যায় যুবক শব্দটিকে মৃত্যুর বিকল্প হিসেবে ধরে নিলে জটিলতার কিছুটা নিরসন হয়। কীভাবে? বলছি-
আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একেবারে কাছের কোন মানুষের মৃত্যুর শোক গ্রাস না করলে মৃত্যুকে বেশ দূরেরই মনে হয়; অত্যন্ত আপন কাউকে বিদায় দেয়ার পরই উপলব্ধ হয় মৃত্যুই আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু; প্রেমিকের কাছে আজীবন যুবতী প্রিয়া যার আলিঙ্গনে ধরা দিয়েছে সেই মৃত্যুকে যুবক মনে করলেই “তার” এবং “তাহার” বিষয়ক ধাঁধাঁর অবসান হয়। সুরঞ্জনার হৃদয়কে ঘাস আর অনন্ত হাহাকারের যৌক্তিকতাও আশা করি এখন পাঠকের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না?

তবে অনেক “যদি”র এই পাঠ কিন্তু নতুন করে আরেকটি প্রশ্নের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় স্তবকের শেষ লাইনে “যেয়োনাক আর” এই “আর” শব্দটির আবির্ভাবেই সমস্ত ব্যাখ্যাটি তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়তে উদ্যত হয়। তবে সুরঞ্জনার ইতিমধ্যে একবার মৃত্যু হয়েছে? তবে কি সুরঞ্জনার পূনর্জন্ম হয়েছে?

তাহলে কি দিনের পর দিন অসংখ্য লঘু মুহুর্তে প্রেমিকের কন্ঠে উচ্চারিত এ কবিতায় বিরহকে ছাপিয়ে যথারীতি মাথা উচিঁয়ে দাড়িঁইয়েছে জীবনানন্দীয় মৃত্যুময়তা?

কবিতার শিরোনাম (“আকাশলীনা”) সেই সম্ভাবনার দিকেই কি অঙ্গুলী নির্দেশ করে না?

 

জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দ দাশ

 

সুরঞ্জনা কবিতা আবৃত্তিঃ

 

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment